বেপোরোয়া চাঁদাবাজরা- দিন বদলের নামে চলছে হাতবদল

02/08/2009 18:02
বেপোরোয়া  চাঁদাবাজরা
দিন বদলের  নামে  চলছে  হাতবদল
ফয়েজ আহম্মদ
চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রনকে কেন্দ্র করে গত ২৮ জুন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিন জন। যাদের মধ্যে রয়েছেন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ মিঞা, কারওয়ান বাজার আদর্শ ফল ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফারুক মোল্লা ওরফে এলসি ফারুক ও ফলের আড়তের কর্মচারী নূরউদ্দীন জুয়েল। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কারণ হচ্ছে আধিপত্ত বিস্তার। রাজধানীর বৃহৎ এই কাঁচাবাজারে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার প্রতিযোগীতা চলে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। এই বাজারে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে শুধু গত দেড় যুগেই খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩০/৩৪ টি।
কারওয়ান বাজেরে এমন ঘটনার পর রাজধানীর সবগুলো বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা এখন ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আতঙ্কের মধ্যে থেকেই। আর চাঁদাবাজরাও তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিগ্নে। তবে মহাজোট সরকার দিনবদলের সনদ নিয়ে মতায় আসার পর থেকেই চাঁদাবাজদের মধ্যে শুরু হয়েছে হাত বদলেল পালা।   

যেভাবে নিয়ন্ত্রন হচ্ছে বাজার:
চাঁদাবাজরা তাদের সুবিধামতো বাজারকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে চালিয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজি। কারওয়ান বাজারকে আট ভাগে ভাগ করে বাজার নিয়ন্ত্রন করছে চাঁদাবাজরা। এগুলো হচ্ছে- বড় মার্কেট ও আড়ত, ডিআইটি এক নম্বর মার্কেট, ডিইআটি দুই নম্বর মার্কেট, হাসিনা মার্কেট, কাব্যকস মার্কেট, কিচেন মার্কেট, কাঠের মার্কেট এবং রেল লাইনের পাশের বিশাল মাছের আড়ত। এই বাজারেকে এভাবে ভাগ করে ৪০ জন লাইন ম্যান চাঁদা তোলে। প্রতি দিন তিন লাখ টাকারও বেশী চাঁদা আদায় করে লাইন ম্যানেরা। এছাড়াও এখানকার প্রতিটি আবাসিক হোটেল প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা করে চাঁদা দেয় বলে জানা যায়।
নিউ মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদানী চক, এবং নীলতে এলাকাকে আলাদা ভাবে কয়েকটি ভাগ করে এখানকার ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে ৩৫ থেকে ৪০ জন লাইন ম্যান প্রতিদিন এখান থেকে দুই লাখের বেশী টাকা চাঁদা আদায় করে।  
গুলিস্তান, বঙ্গবাজার এবং পল্টন এলাকার চিত্র একই। এই এলাকায় ফুটপাতে দোকান বসে অন্তত দুই হাজার। ২০ থেকে ২৫ জন লাইন ম্যান নিয়ন্ত্রন করে এই এলাকাকে। প্রতিদিন চার লাখের বেশী টাকা আদায় করে এই লাইন ম্যানেরা। 

যারা নিয়ন্ত্রন করছে বাজার:
রাজধানীর বৃহৎ কাঁচাবাজর কাওরান বাজারে চাঁদাবাজি শুরু হয় ১৯৯৫সাল থেকে। তখন এর নিয়ন্ত্রণ ছিল সুইডেন আসলামের হাতে। সুইডেন আসলাম গ্রেপ্তারের পর ১৯৯৭ সালে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় পিচ্চ হান্নান। এ সময় তার হাতে খুন হয় ১১ জন। পিচ্চি হান্নান ২০০৪ সালে র‌্যাবের ক্্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর কিছুদিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকে। ২০০৪ সালে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন। ২০০৫ সালে সাহাবুদ্দিন ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর এ মহান দায়িত্ব (!) নেন বিএনপি নেতা এল রহমান,নবী সোলয়মান,লেবু শহীদ। মহাজোট মতায় আসার পর যুবলীগ(উত্তর)দফতর সম্পাদক মামুন মতা নেয়। দেড়মাস আগে মামুন রহস্যজনক ভাবে নিহত হয়। এখন আধিপত্য ধরে রেখেছে আশিক গ্র“প।
নিউ মার্কেট এলাকায় মহাজোট সরকার মতায় আসার আগে পর্যন্ত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন ছিলো ২৪ জনের একাদিক গ্র“পে। এই গ্র“পগুলোর মধ্যে ছিলো চার জন পেশাদার খুুনি, তিন জন অবৈধ অস্ত্রধারী, পাঁচ জন মাদক ব্যবসায়ী। যাদের ১৪ জন এখন কারাগারে। অপর ১০ জন আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে জানান নিউ মার্কেট থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন। এই ২৪ জনের মধ্যে অন্যতম কামাল উদ্দিন, হুমায়ুন কবির ওরফে গুজা হুমায়ুন, শেখ কামাল, দেলোয়ার হেসেন ওরফে কালা বাবু,আবু তাহের এবং মুন্না। এই এলাকার বর্তমান নিয়ন্ত্রন নিয়ে একাদিক গ্র“পের মধ্যে চলছে চাপা উত্তেজনা।  নতুন আধিপত্য বিস্তারের আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাপ্পু, আবিদ এবং রিপনের গ্র“প। এরা প্রত্যেকেই সরকারি দলের নেতা কর্মী। এই গ্র“পগুলোর চাপা উত্তেজনা থেকে যে কোন সময় বড় নাশকতা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সাধারন ব্যবসায়ীরা।
গুলিস্তান এলকার চিত্র অবশ্য একটু ভিন্ন। যখন যে সরকারই মতায় থাকুক এ এলাকার চাঁদাবজির নিয়ন্ত্রন মতা সবসময়ই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা কর্মীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্টের নাম করে কিছু নেতা কর্মী চালিয়ে যায় নিরব চাঁদাবাজি। এলাকার নিয়ন্ত্রন থাকে এহাত সে হাত ঘুরে থাকে এদের হাতেই।
গুলশান ও কাফরুল এলাকায় গত সাত বছর চাঁদা আদায়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল ইমাম হোসেন ও চিকনা মনিরের সহযোগীদের হাতে। উল্লেখ্য পুরষ্কার ঘোষিত এই দুই সন্ত্রাসী র‌্যাবের ক্রসসফায়ারে মারা যায়। মহাজোট সরকার মতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একাধিক গ্র“প আধিপত্যের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
রমনা এলাকার চাঁদাবাজির নায়ক হিসেবে পরিচিত দুই শীর্ষ সন্ত্রসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। জোট সরকারের আমলে এই নায়কদের নামে মাত্র নিয়ন্ত্রন থাকলেও কার্যত সক্রিয় ছিলো বিএনপির বিভিন্ন গ্র“প। মহাজোট সরকার মতায় আসার পর থেকে তাদের সহযোগীরা আবারও নিয়েন্ত্রন নিয়েছে এই এলাকার। যার মধ্যে জিসান, খিজির আলম, আরিফ, সোহেল, সালাম, স্বপন, সিরাজ, আকরাম, লন্ড্রি দুলাল, সুলতান, মুন্না, হুন্ডা বাবু, শামিম, ইলিয়াস এবং উৎপল।
তেজগাঁও এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন এখন আশিক গ্র“পের সদস্য বাবুল, বিপ্লব, মনির, সায়েম, বাদল, সাইদুল এবং খোকন ওরফে কানা খোকন। আশিক গ্র“পের এই সদস্যদের হাত থেকে নিয়ন্ত্রন নিতে সঙ্গবদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় ছাত্রলীগ।  
মিরপুর ও পল্লবী এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন করছে শাহাদাত- খোরশেদ বাহিনী। এ বাহিনীর মিজান, আশিক এবং মামুন চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে বলে জানা যায়।
শাহবাগ এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন করছে গোপালগঞ্জ গ্র“প। এদের অধিকাংশই ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার অভিযুক্ত আসামি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ড. শামছুল হক ভূঁইয়া এদের মদদ দিচ্ছেন বলে জানা যায়।
পুরান ঢাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন দীর্ঘদিন থেকেই ডাকাত সরদার শহিদের হাতে। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি গ্র“প নিয়ন্ত্রন নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা যায়।
 
চাঁদার টাকা ভাগাভাগি:
রাজধানীর সবগুলো বাজারেই চাঁদর টাকা ভাগাভাগির চিত্র একই রকম । লাইন ম্যান টাকা তুলে সেই টাকাকে তিন ভাগ করে। এক ভাগ নেতারা, এক ভাগ  মার্কেটের মালিক সমিতি অথবা ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠন এবং অপর ভাগ পায় পুলিশ। আর এই ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে মাঝে মধ্যেই চলে সংঘর্ষ।  

চলছে হাত বদল:
মহাজোট সরকার দিন বদলের প্রত্যয়ে মতায় আসার পর থেকেই  চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রনে চলছে হাত বদল। এই হাত বদলের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কারওয়ান বাজারে দি দুপুরে পড়েছে তিনটা লাশ। পেশাধার চাঁদাবাজরা সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুত হয়ে যায় মতা ছেড়ে দেয়ার জন্য। চাঁদাবাজির বাজার এখন সে পথেই এগুচ্ছে। সরকারের ছয় মাস বয়স হয়ে গেলেও কেন এখনও হাত বদলের কাজ সম্পন্ন হয়নি? কারণ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষনাকে চাঁদাবাজরা কিছুটা ভয়ের কারণ হিসবেই দেখছিলো। কিন্তু এখন! যা হবার তাই । বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সাত বছর পুনরায় ফিরে এসেছে। আবার শুরু হচ্ছে তাদের সন্ত্রসীসহ চাঁদাবাজির কর্মকান্ড।

চাঁদা দিতে হচ্ছে একাদিক গ্র“পকেই:
কে বা কোন গ্র“প নেবে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন, তা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। গত ছয় মাসে সারা দেশে যে কটি সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই এসব গ্র“পগুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু যারা চাঁদা দেয়ার তারা চাঁদা দিয়েই যাচ্ছে। এমন কয়েক জন ভুক্তভোগীরা জানান, কোন একটি গ্র“প যদি চাঁদা নিতো তাহলে এক গ্র“পকে চাঁদা দিয়ে নিস্তার পাওয়া যেত। কিন্তু একাদিক গ্র“পের মধ্যে এখনও কোন প্রকার সমঝতা না আসার কারনে যখন যে গ্র“প চাচ্ছে সেই গ্র“পকেই দিতে হচ্ছে তাদের চাহিদা মতো চাঁদা।

দোকানের আকার ভেদে রেট:
সব দোকান থেকে একই হারে চাঁদা তোলে না চাঁদাবাজরা। দোকানের আকার অনুযায়ী চাঁদা নির্ধারিত হয়। ফুটপাতের খুদে ব্যবসায়ীদের প্রতি দোকান থেকেই ২০-১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে। মার্কেটের ভিতরের প্রতি দোকান থেকে ৫০০০-৫০০০০টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়। যেসব ব্যবসায়ীরা সরকার দল সমর্থিত তাদের চাঁদা দিতে হয় না। যেসব ব্যবসায়ীরা বিরোধী দল বা কোন  দলই সমর্থন করে না তাদের গুনতে হয় অনেক চাঁদার টাকা। সরকারি দল সমর্থিত ব্যবসায়ীদের যোগশাজসে
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।  

ভিুকরাও মুক্ত নয় চাঁদাবাজদের হাত থেকে:
একসময় ভিুকের আনাগোনা দেখা যেত মাজার,মসজিদ,গোরস্থানে। বর্তমানে বাসটার্মিনাল,লঞ্চটার্মিনাল,মার্কেট,পার্ক থেকে শুরু করে স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাফিক সিগন্যালে রয়েছে এদের সরব উপস্থিতি।  সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,আজিমপুর,হাইকোর্ট,মিরপুর শাহআলী মাজার,বনানী গোরস্থানে বড় ২০টি স্পট আছে। এগুলোতে ভিা করে দেশের প্রথম সারির ভিুকেরা। আজিমপুর গোরস্থানের গেটে বসা ভিুক আব্দুল জব্বার জানায়,যে যত বড়মাপের বিকলাঙ্গ সে তত বড়মাপের ভিুক
বিভিন্ন স্থানের ভিুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় ভিুকদের দৈনিক দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়ে থাকে।
এখান থেকে মালিককে অর্ধেক দিতে হয়। তারা জানান, মালিককে তারা চিনেন না।রাতে কালেকশানে আসা একজনকে চিনি। এসব এলাকায় দুই হাজার ভিুক দিনে ১০ লাখ টাকা আয় করে । মুরুব্বিদের অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়।এলাকার কিছু লোককে স্পট ভাড়া হিসেবে ৫০-১০০ টাকা দিতে হয়।  

সংবাদপত্র বিক্রেতারা অন্যরকম চাপে:
সংবাদপত্র বিক্রেতাদের ওপর ভিন্ন দৃষ্টি চাঁদাবাজদের। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ন সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায় চাঁদাবাজরা তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার চাঁদা দাবি করে না। তবে মাঝে মধ্যে কিছু লোক এসে নেতাদের নাম বলে পত্রিকা, ম্যাগাজিন নিয়ে যায়। না দিতে চাইলে মারার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ করেছেন শাহবাগ ও ফার্মগেইট এলাকার কয়েকজন বিক্রেতা। কখনও যদি কোন পত্রিকা কোন নেতার বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট করে তাহলে ওই পত্রিকা নিয়ে যায় নয়তো সরিয়ে ফেলতে বলে।
টহল পুলিশরা পত্রিকা, ম্যাগাজিন নিয়ে কখনও কখনও ফেরত দেয় না। আবার ফেরত দিলেও বিক্রয়ের অনোপযোগী করে ফেরত দেয়। পুলিশদের কিছু বললে তারা গালাগাল করে। আবার অনেক পুলিশ ওসি স্যার চেয়েছেন এমন বলে পত্রিকা নিয়ে যায়।
Back

Search site

Thanks For All