শ্রমবাজার অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বর্হিবিশ্বে

29/07/2009 16:43

ফয়েজ আহম্মদ:


বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিশ্বমন্দার প্রত্য প্রভাব না পড়লেও এর পরো প্রভাব বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য। এই পরো প্রভাব বড় আঘাত ফেলছে রাজস্বের ওপর। বিদেশ থেকে শ্রমিকদেও পাঠানো অর্থের রাজস্বই বাংলাদেশের সবচে বড় রাজস্ব খাত। অথচ বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কারন হিসেবে দেখা হচ্ছে বিশ্বমন্দা ও জ্বালানী তেলের দাম কমে যাওয়া। সরকারি হিসাব মতে চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৩ শ্রমিক পাঠানো হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। গত বছর একই সময়ে এর হার ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৮৯৮ জন।
গত বছরের তুলনায় ৩ মাসে কমেছে ৮৫ হাজার ৪৬৫ জন। এ বছরের মে পর্যন্ত বিদেশ থেকে ফেরত এসছে ৩৮ হাজার ২০৮ বাংলাদেশী শ্রমিক। সরকারের প থেকে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার বলিষ্ঠ পদপে গ্রহন করতে দেখা যায়নি।

বিশ¡জুড়ে চলা অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন শত শত প্রবাসী কর্মী। অনেক েেত্র জোর করেই বাংলাদেশী কর্মীদেও ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফেরত আসা কর্মীরা। চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে শ্রমবাজারের এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের জনশক্তির সচচে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং মালয়েশিয়া থেকেই প্রতিদিন শত শত প্রবাসী কর্মী জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করছেন। এসব দেশ থেকে আসা বিমানগুলোর অধিকাংশ যাত্রীই প্রবাস ফেরত কর্মী। নিজের দেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমীক পাঠিয়ে দেয়ার তালিকায় মালয়েশিয়া মারিশাসের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে আরব আমিরাতও। চলতি মাসেই ১০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক দেশে পাঠিয়ে দেয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরব আমিরাত সরকার। এর আগে মালয়েশিয়ান সরকার ৫৫ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকের ভিসা বাতিল এবং ছয় হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় মারিশাস সরকার। মারিশাস থেকে এই ছয় হাজার শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই। এর মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি মালয়েশিয়ন সরকারের সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনা করলেও কোন সফলতা আসেনি।
এ ব্যাপারে বায়রা সভাপতি গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমাদের দেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব না পড়লেও এর প্রভাবে উন্নত বিশ্বের কাঠামোতে আসছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সাময়িক ভাবে আমাদের কিছুটা তির কারন হলেও। ভবিষ্যতে বর্হিবিশ্বে ব্যাপক জনশক্তির প্রয়োজন হবে। তখন প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ হতে পারে অন্যতম। আশা করা যায়  ১০ বছর পর বাংলাদেশ শ্রমবাজারের জন্য প্রথম এবং প্রধান দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি বলেন দূতাবাসের ব্যর্থতার কারণে দেশের রেমিট্যান্স খাতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে সরকারকে দ্রুত পদপে নিতে হবে।
জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানাযায়, বর্তমান বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে ফেরত এসেছেন ৪ হাজার ৮১৭ জন। একইভাবে ফেব্র“য়ারি মাসে ৮ হাজার ২২ জন, মার্চে ৯ হাজার ১২৭ জন এবং এপ্রিল মাসে ৮ হাজার ৭০০ জন শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। অথচ ২০০৮ সালের একই সময়ে দেশে ফেরত এসেছিলেন ১৮ হাজার ৩৬৫ জন শ্রমিক।

বিশে¡র প্রায় ৬৯টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ কর্মী কর্মরত আছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমিক যাতায়তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র সৌদি আরবে কর্মরত আছে সর্বচ্চো ২০ লাখ শ্রমিক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের নভেম্বর থেকে জনুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে জনশক্তি রফতানির পরিমান ছিল ২লাখ ৫৩ হাজার। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে একই সময়ে, দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ৫০ হাজার ৬৩২ জন , ডিসেম্বরে ৪৪ হাজার ৩৭৮ জন এবং নভেম্বরে ৬৮ হাজার ৭৪ জন বিদেশ গেছেন। অপর দিকে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে নভেম্বরে ৮৩ হাজার ৩৩৫ জন, ডিসেম্বরে ৭৭ হাজার ৯৭৭জন এবং জানুয়ারিতে ৯১ হাজার ৯৯৯জন শ্রমিক বিদেশ যান। দুই সময়ের জনশক্তি রফতানির হিসাব পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়,  এ সরকার মতায় আসার পর থেকে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ কি হারে কমেছে। একদিকে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ যেমন কমেছে তেমনি কমছে দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণও। বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে মোট রেমিটেন্সের ৬৫ ভাগ আসে । যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ থেকে আসে ২৭ ভাগ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যমতে, এবছর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ উলে−্যখযোগ্য হারে কমবে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। আর ২০০৯ এর প্রথম মাসে রেমিটেন্স এসেছে ৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ফেব্র“য়ারিতে ৭৮ কোটি ৪০লাখ টাকা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীায় বলা হয়েছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিদেশে অভিবাসী বাংলাদেশী নারীর সংখ্যা ৬২ হাজার, যা ওই সময়ের মোট প্রবাসীর এক শতাংশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী নারীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন আট শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশী নারী।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে বহি:বিশ্বে বার্ষিক অভিবাসনের হার ছিল প্রায় তিন লাখ। ২০০৭ সালে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন চাকরি নিয়ে বিদেশ যান এবং ২০০৮ সালে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন। শতকরা ৮০ ভাগ বাংলাদেশী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমানে কাজ করছেন। যার শতকরা ৪৫ ভাগ রয়েছেন সৌদি আরবে, আমিরাতে ১৭ ভাগ এবং কুয়েতে রয়েছেন ৯ ভাগ বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় বহিরাগত শ্রমিকদের শতকরা তিন ভাগ এবং সিঙ্গাপুরে ছয় ভাগ বাংলাদেশী কাজ করছেন।

বিদেশ থেকে লাশ হয়ে ফেরত:
দেশের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশ গিয়ে সেখান থেকে লাশ হয়ে ফিরে আসার ঘটনার ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে। সরকারি হিসাব মতে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত লাশ হয়ে এসেছে ১২ হাজার ৩০৭ শ্রমিক। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এখানেও আছে নানা যন্ত্রনা। অনুসন্ধানে জানাযায়, দুতাবাসে ঘুষ ছাড়া কোন শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে এসেছে এবং ঘুস ছাড়া বাংলাদেশ বিমানবন্ধর থেকে লাশের কফিন খালাস পেয়েছে এমন ঘটনা বিরল। ফেরত আসা লাশের স্বজনদের এমন কেউ নেই যে ঘুষ ছাড়া লাশ নিতে সম হয়েছেন।

দূতাবাসে লাঞ্চনা :
প্রবাসী শ্রমিকদেরকে প্রতিনিয়ত শিকার হতে হয় অনেক নির্যাতন ও সীমাহীন লাঞ্চনা বঞ্চনার। দৃতাবাসে বার বার অনেকা আবেদন, অভিযোগ এবং স্মারকলিপি দিয়ে কোন প্রকার প্রতিকার পান না প্রবাসী এই শ্রমিকরা। বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসে কর্মরত ব্যাক্তিরা সেসব দেমে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৃষ্টি করার কথা থাকলেও তারা সেখানে জড়িয়ে পড়ছেন দুর্নীতি ও ঘুস বানিজ্যের সঙ্গে। প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলের থাকা কয়েকশ’ কোটি টাকায় তাদের  কোন উপকার না করে  সেই টাকা লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে দূতাবাস এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেও বিরুদ্ধে। এই টাকাগুলো আসছে শ্রমিকদের দেয়া তাদের  সুবিধা- অসুবিধা দেখাশোনা, আহত হলে চিকিৎসাসেবা প্রদান, মারা গেলে লাশ ফেরত আনাসহ অন্যান্য কল্যাণমুলক কাজের জন্য। এই বিষয়গুলোর জন্য প্রত্যেক শ্রমিককেই দিতে হয় এক হাজার টাকা করে। এ খাতে কয়েকশ’ কোটি টাকা এখন সরকারের তহবিলে রয়েছে।

কর্মকর্তারা লুটপাট করে নিলেও  প্রবাসে বাংলাদেশী কর্মীদের কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির ল্েয বিগত জোট সরকার ২০০১ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। বিদেশে শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দূতাবাসে ১০টি শ্রম উইং রয়েছে। এগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়া। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রবাসীদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, প্রবাসী কল্যাণ সোসাইটি করা সহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে যার কোনটিই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থান বিবেচনা করলে দেখাযায় গত বছর প্রতিটি দেশেই নান নির্যাতন, নিস্পেসন, লাঞ্চন-বঞ্চনা, কারাভোগ এবং বেতন কেটে নেওয়ার ঘটনা সবচে বেশী। এধরনের ঘটনায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা নিজ নিজ অবস্থানরত দেশ থেকে কোন প্রকার সহযোগীতা না পেলেও অতিরিক্ত ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। অথচ প্রতিবাদ করার কারনে বহু শ্রমিককে খালি হাতে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। অভিযোগ আছে বিভিন্ন  দেশে ওয়ার্ক পারমিট বার্ষরিক ফি বাবদ নির্দিষ্ট টাকার দ্বিগুন টাকা আদায় করে অভিযুক্ত দেশগুলোর কতৃপ। আর এবিষয়ে রহস্যজনকভাবে চুপ থাকে বাংলাদেশ দূতাবাস।

Back

Search site

Thanks For All